শরীরে বিভিন্ন কাজের জন্যে হাজার রকম রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজন হয় । কোষের ভেতরে এমন অনেক কাজের জন্যে তেমন একটি বিশেষ উপাদানকে বলে - ভিটামিন ।
ইংরেজিতে Vitamin । কিন্তু একসময় শব্দটি Vitamine লেখা হতো । একটি অতিরিক্ত E দেয়া হতো । কারণ - ১৯১২ সালে পোলিশ বায়োকেমিস্ট Casimir Funk যখন প্রথম ভিটামিন আবিষ্কার করেন, ধরে নিয়েছিলেন এটি Amonia থেকে উৎপত্তি হয় বলে amine গ্ৰুপের । শরীরের একটি দরকারি বা Vital elements মনে করা হয় বলে Vi + amine মিলে Vitamine নাম দেয়া হয়েছিল । পরবর্তীতে জানা গেলো যে - ভিটামিন আসলে amine গ্ৰুপের নয় । তারপর থেকে অতিরিক্ত e বাদ দিয়ে লেখা হতে লাগলো - Vitamin !
শরীরে এমন ১৪ টি ভিটামিন দরকার হয় । ভিটামিন D তার একটি ।
ভিটামিন D পাঁচ রকমের হলেও দুটি ধরন নিয়ে বেশি কথা হয় । D2 এবং D3 । বাকিগুলো D1, D4 এবং D5 ।
D2 ভিটামিনের রাসায়নিক নাম Ergocalciferol । D3 ভিটামিনের নাম Cholecalciferol ।
শরীরে ভিটামিন D -এর মূল উৎস ভাবা হয় সূর্যের আলো । অনেকে তাই Sunshine Vitamin বলে একে । সূর্যের আলো গায়ে এসে পড়লে UVB রশ্মি ত্বকের Epidermis স্তরে থাকা একধরনের কোলেস্টেরল 7-dehydrocholesterol -কে কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় লিভার এবং কিডনির সাহায্যে ভিটামিন D -তে পরিণত করে ।
শরীরের এই উৎস ছাড়াও প্রাণী এবং উদ্ভিদ থেকে ভিটামিন D পাওয়া যায় । কোন ধরনের ফলে ভিটামিন D থাকে না । সবজির মধ্যে মাশরুম এবং সয়া থেকে বানানো Tofu -তে এই ভিটামিন থাকে । ডিমের হলুদ অংশ এবং বিফ লিভারে সামান্য ভিটামিন D আছে । সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় স্যামন, সার্ডিন এমন মাছগুলোতে । অনেকদিন থেকে লোকেরা Cod মাছের লিভার থেকে তৈরি Cod liver oil ভিটামিন D -এর প্রধান সাপ্লিমেন্ট হিসাবে খেয়ে থাকে ।
ভিটামিন D -এর ইন্টারন্যাশনাল ডেইলি RDA বা recommended dietary allowance হল - এক বছরের নিচে বাচ্চাদের ৪০০, এক থেকে সত্তর বছরের মধ্যে হলে ৬০০ এবং সত্তরের উপরে বয়স হলে ৮০০ IU বা International Units দরকার ।
রক্তে ভিটামিন D পরীক্ষার নাম 25-hydroxy vitamin D test । ২০ থেকে ৫০ ng/mLধরা হয় ভিটামিন D -এর স্বাভাবিক মাত্রা ।
১২ ng/mLএর নিচে হলে ধরা হয় এই ভিটামিনের প্রবল ঘাটতি আছে । এমন হলে বাচ্চাদের Rickets এবং প্রাপ্তবয়স্কদের Osteomalacia এবং Osteoporosis হয় ।
৫০ ng/mL এর উপরে হলে ভিটামিন D Toxicity দেখা দেয় । এতে শরীরে ক্যালসিয়ামের আধিক্য দেখা দিয়ে কিডনি, হাড়সহ অনেক অংশের স্বাভাবিক কাজকে ব্যাহত করে ।
ভিটামিন D -এর অনেকগুলো কাজ । কিন্তু শরীরে তার প্রধান কাজ হাড়ের গঠনে ঠিক রাখা । হাড় তৈরি, পুনর্গঠন এবং ঠিক রাখতে ক্যালসিয়াম একটি দরকারি উপাদান । ভিটামিন D ক্যালসিয়ামের শোষণ এবং রক্তে স্বাভাবিক পরিমাণটি নিয়ন্ত্রণ করে ।
হাড়ের গঠনে সাহায্য করা ছাড়াও শরীরে ইনফেকশনের বিরুদ্ধে কাজ করতে ভিটামিন D সাহায্য করে । সাম্প্রতিক গবেষণায় এটি পরিষ্কার হয়েছে যে - শরীরের ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভিটামিন D -এর ভূমিকা আছে ।
পরীক্ষায় দেখা গেছে - ইমিউনিটি সিস্টেমের অংশ T cell, B cell এবং Macrophage, তিনটির কাজে ভিটামিন D -এর দরকার হয় । সাথে এটাও দেখা গেছে যে - ভিটামিন D এর অভাবে Autoimmune diseases যেমন : আর্থাইটিস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস এগুলো বৃদ্ধি পায় ।
করোনা ভাইরাসের সাথে ভিটামিন D -এর সম্পর্কটা কি তাহলে ?
সম্প্রতি জার্মানির স্টুর্টগার্ডে University of Hohenheim সহ ইংল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, আয়ারল্যান্ড সহ ইউরোপ, এশিয়া এবং আমেরিকায় ৮ টি গবেষণা হয়েছে কোভিড-১৯ এর সাথে ভিটামিন D -এর সম্পর্ক নিয়ে ।
গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন D -এর সাথে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সরাসরি কোন সম্পর্ক না থাকলেও ভিটামিনটির অভাবে অন্য আর কিছু শারীরিক সমস্যার উপস্থিতি ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হওয়া এবং মুমূর্ষু হওয়া, এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে ।
তারমানে ভিটামিন D -এর অভাব পূর্ব থেকে থাকা রোগের সহযাত্রী হিসাবে পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে । তাহলে ভিটামিন D বেশি করে খেলে কি ভাইরাসের আক্রমণ কমে ? অথবা ভিটামিন D কি করোনা ভাইরাস থেকে কোন ভাবে রক্ষা করে ? অথবা ভিটামিন D কি কোবিড-১৯ এর উপর কোন ভাবে প্রভাব বিস্তার করে ?
এর উত্তর জানতে গিয়ে ইংল্যান্ডে কমিউনিটি হেলথ দেখা শোনা করার ডিপার্টমেন্ট Public Health England (PHE) গত মাসে কোভিড-১৯ এবং ভিটামিন D -এর সম্পর্ক নিয়ে এ পর্যন্ত হয়ে যাওয়া ১৮৭ টি লিটারেরি রেফারেন্সকে জড়ো করে তার মধ্য থেকে ৫ টিকে পুনরায় বিচার বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন এবং একটি নির্দেশনা দেন ।
বিশ্লেষণে ৪ টি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় ।
1. কোভিড ১৯ ট্রিটমেন্টে ভিটামিন D -এর ভূমিকা আছে কিনা
2. কোভিড ১৯ প্রতিরোধে ভিটামিন D কোন ভূমিকা রাখে কিনা ।
3. ভিটামিন D এর অভাব থাকলে তা কোভিড ১৯ এ সহজে আক্রান্ত হওয়াতে কোন ভূমিকা রাখে কিনা ।
4. এমন কোন গ্ৰুপের কিছু মানুষকে বের করা যায় কিনা যারা ভিটামিন D গ্রহণ করলে কোভিড ১৯ আক্রান্ত না হওয়ার সুবিধাটি পেতে পারেন ।
প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর ছিল - না । কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা কিংবা প্রতিরোধে ভিটামিন D -এর কোন ভূমিকা নেই ।
তৃতীয় প্রশ্নটিতে কয়েকটি গ্ৰুপে ভাগ হয়ে গেছে । ভিটামিন D-এর অভাব সরাসরি কোভিড-১৯ এ কোন ভূমিকা না রাখলেও দেখা গেছে যে - বয়স, এথনিসিটি, পূর্ব থেকে কিছু রোগ, আবহাওয়া, এমন কিছু ফ্যাক্টরের পাশাপাশি অবস্থান এবং ভিটামিন D -এর অভাব কোভিড আক্রান্ত হওয়াতে ভূমিকা রাখে । যেমন : কালো এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মানে উপমহাদেশের মানুষদের ত্বকে মেলানিনের ঘনত্ব বেশি থাকায় সূর্যের UVB রশ্মি পর্যাপ্ত ভিটামিন D তৈরিতে বাধা দেয়, যা শরীরকে ভিটামিনের ঘাটতির মধ্যে রাখে ।
চতুর্থ প্রশ্নের উত্তরে দেখা গেছে - ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসের দীর্ঘদিনের সমস্যা, পার্কিনসন্স ডিজিজ, স্থূলতা (obesity), এমন গ্ৰুপের লোকেরা ভিটামিন D খেলে ভাইরাসে সহজে আক্রান্ত হওয়া কিংবা আক্রান্ত হলে সমস্যা প্রকটের দিকে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারেন ।
লক-ডাউন পরিস্থিতি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় অনেক ভাবেই এখন আমাদের বাহিরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে । ফলে পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর মুখোমুখি হয়ে ভিটামিন D -এর একটি অন্যতম উৎসতে বাধার সৃষ্টি হয়েছে । সাথে খাদ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ এবং সীমিত পছন্দের কারণে খাদ্য উৎসতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে । এমন পরিস্থিতিতে সবারই শরীরে কম-বেশি ভিটামিন D -এর ঘাটতি তৈরি হচ্ছে ।
পরামর্শ হল : সুস্থ যে কেউ প্যান্ডেমিক সময়ে প্রতিদিন ১০ মাইক্রোগ্রাম বা ৪০০ IU এবং যারা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় পূর্ব থেকে আক্রান্ত, তারা প্রতিদিন ২০ মাইক্রোগ্রাম বা ৮০০ IU পর্যন্ত ভিটামিন D জাতীয় সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত খেলে ভালো হয় । এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই দৈনিক ১০০ মাইক্রো গ্রামের বেশি খাওয়া যাবে না ।
0 Comments